সামহোয্যারইন ব্লগের দৃশ্যযোগ্য সাহিত্যকর্ম 'অপরবাস্তব' শিরোনামে স্পর্শযোগ্য হয়ে ওঠার পর ...
সামহোয়্যারইন ব্লগের ভিজিবল বা দৃশ্যযোগ্য রচনাদির সংকলন 'অপরবাস্তব' এর আগেও ৩ টি সংখ্যা বেরিয়েছে। ব্লগার রাশেদুল হাফিজ ও বাকীবিল্লাহ যে উদ্যোগ নিয়েছিল দৃশ্যযোগ্য রচনাদিকে স্পর্শযোগ্য হিসেবে প্রকাশের-- তা ২০০৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি 'অপরবাস্তব'-এর ১ম সংখ্যাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে সার্থকতা লাভ করেছিল। এরপর ২০০৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এর ২য় সংখ্যাটিও প্রথম সংখ্যার সংকলক অন্যমনস্ক শরৎ একটি নির্বাচকমণ্ডলীর সহায়তায় প্রকাশ করেন। 'অপরবাস্তব'-এর ৩য় সংখ্যাটি ব্লগার লোকালটকের একক সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। ২০১০ সালে প্রকাশিত 'অপরবাস্তব'-৪ সম্পাদনা করেছেন-- লোকালটক, আব্দুর রাজ্জাক শিপন, কৌশিক আহমেদ; অবশ্য এই প্রধান তিন সম্পাদকের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন একরামুল হক শামীম এবং নীরা আহমেদ অপ্সরা। গৌরচন্দ্রিকার এসব কথা, যারা গ্রন্থটি পাঠ করেছেন, তাদের জন্য বিরক্তিকর মনে হলেও আমি যারা গ্রন্থটি পাঠ করেননি এমন পাঠকবৃন্দের কথা মাথায় রেখেই এ ভূমিকা করতে বাধ্য হলাম।
'অপরবাস্তব'-৪ শীর্ষক ভিজিবল রচনাদিকে টাচেবল বা স্পর্শযোগ্য করে তোলা হয়েছে মোট সাতটি আলাদা শিরোনামে।
রাগিব হাসানের ধর্ম বিষয়ক নির্জলা সত্য ভাষণ...
সূচির শুরুতে রাগিব হাসন রচিত প্রবন্ধ 'ভাষার ধর্ম, ধর্মের ভাষা শীর্ষক রচনায় সুপরিচিত সামাজিক বিভাজনের চিত্র উঠে এসেছে। 'পানি' আর 'জল' শব্দের প্রায়োগিক সামাজিক ও ধর্মীয় বিভাজনগত গোঁড়ামি বিষয়ক বাঙালির ধর্ম-পরিচয় লেখক সংক্ষিপ্ত রূপে সুখপাঠ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। ভাষার ধর্মীয় বিভাজনের কথা লেখক উপস্থাপন করেছেন এভাবে :
দাদা আর ভাই, জল আর পানি-- কেমন করে যেন বাংলঅ শব্দগুলো চাপা পড়েছে ধর্মের লেবাসে, তাই গোসল আর স্নানে, নিমন্ত্রণ আর দাওয়াতে আমরা চিনে নেবার চেষ্টা করি মানুষের ধর্মীয় পরিচয়, এক লহমায় ফেলে দেই স্টেরিওটাইপে। পৃ.১০
ভাষার এই ধর্মগত বিভাজনের ক্ষেত্রে হিন্দু কিংবা মুসলমান কোন সম্প্রদায় এককভাবে দায়ী নয়, সেকথা বললেও মানুষ বুঝতে পারে। তবে একথা শব্দের এই ধর্ম-বিভাজনের মধ্য দিয়ে সামগ্রিকভাবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের এক ধরনের অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্যকিছু নয়। জাতীয়ভাবে অসাম্প্রদায়িক পরিচয় পেতে হলে সমগ্র জাতির সামিষ্টিক প্রয়াসের মধ্য দিয়ে এই ভাষাগত সীমাবদ্ধতা দূর করতে হবে।
বক্তব্য প্রধান রাগিব হাসানের লেখাটির জন্য তাকে ধন্যবাদ।
মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে ...
'অপরবাস্তব'-৪ এর দ্বিতীয় প্রবন্ধটি লিখেছেন ফাহমিদুল হক। শিরোনাম-- 'বিজ্ঞাপন-হাটে হঠাৎ সংবাদ : টিভি সংবাদের কর্পোরেট ব্র্যান্ডিং'। ক্রমাগ্রসমান বিজ্ঞানের যুগে পৃথিবীব্যাপী ভিজুয়াল মিডিয়া জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি। পিছিয়ে পড়েছে রেডিও। টিভি মিডিয়ার অন্যতম চাহিদা সংবাদ। কারণ, দেশের অথবা বিদেশের নিত্যদিনের ক্ষণের খবরাদি জানার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু এ প্রবন্ধের লেখক সংবাদিকতা বিষয়ের শিক্ষক হওয়ার পরও নিজের সংবাদ-বিমুখ হওয়ার যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার প্রকাশ করেছেন লেখাটিতে। শুধু লেখক ফাহমিদুল হকেরই নয়, কারোই ৪৭ মিনিটের সংবাদ দেখার জন্য ২০ মিনিটব্যাপী বিজ্ঞাপন দেখার মতো আলগা সময় নেই। বিজ্ঞাপনের উপদ্রুব শুধু ভিজুয়াল মিডিয়াতেই নয়, প্রিন্ট মিডিয়াতেও বিরাট অংশ জুড়ে আছে। কারণ, পুঁজিবাদী অর্থনীতি শিখিয়েছে-- প্রচারেই প্রসার। অতএব মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা নেমেছেন প্রচারের প্রতিযোগিতায়। তাদের প্রতিযোগিতার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়েই সম্ভবত কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন-- 'মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে'। প্রবন্ধ লেখকসহ আমাদের ক্ষেত্রে শঙ্খ ঘোষের কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলা যায়-- আমাদের সময় ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। প্রয়োজনীয় সময়ের অপব্যবহারের মাত্রা কেমন তা ব্যখ্যা দিয়ে ফাহমিদুল হক জানিয়েছেন :
[...] বাংলাদেশের বেসরকারি টিলিভিশন চ্যানেলের সংবাদের নামে যা চলছে, তা গোটা দুনিয়াতেই অদৃষ্ট। অন্তত আমাদের চেনাজানার মধ্যে কোনো দেশের টিলিভিশন-সংবাদেই এমনটা দেখা যায় না যে, সংবাদের প্রতিটি স্লট বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। সংবাদ যেন তাই যা বিজ্ঞাপনের আগে, পরে বা মাঝখানে পরিবেশিত হয়।-- পৃ.১১
অতএব লেখক টেলিভিশন মিডিয়ার এই বিজ্ঞাপন প্রচারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নির্ধারণের লক্ষ্যে কর্তৃপক্ষের নিকট আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। কারণ, জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব হবে না-- যদি না, সামষ্টিক জনগণ সময়েকে কদর করতে কিংবা সময় সচেতন না হয়। সংবাদ জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেই সংবাদটুকু জানতে গিয়ে যদি আমাদেরকে ৪৩ ভাগ সময় ব্যয় করতে হয় বিজ্ঞাপন দেখার কাজে তাহলে উন্নয়ন হবে কিভাবে? সংবাদের মধ্যে বিজ্ঞাপন প্রচারের নমুনা তুলে ধরে ফাহমিদুল হক লিখেছেন :
'তার আছে 'সিটিসেল সংবাদ শিরোনাম', 'ইস্টার্ন ব্যাংক বিরতি', 'গ্রিন ডেল্টা ইন্সুরেন্স বাণিজ্যিক সংবাদ', 'ন্যাশনাল ব্যাংক অর্থনীতি সংবাদ', 'আনন্দ আলো সাংস্কৃতিক সংবাদ'।' পৃ.১২
অর্থাৎ সংবাদের প্রতি অংশ বিজ্ঞাপনদাতাদের নিকট বিক্রি হয়ে গেছে। বলাবাহুল্য লেখক ফাহমিদুল হক বিজ্ঞাপন হাটের এই তথৈবচ অবস্থা তুলে ধরার মাধ্যমে জাতীয় জীবনে সময় জ্ঞানের অপরিচার্যর নির্ধারণ করেছেন এবং তাগাদা দিয়েছেন বাঙালিকে সময় সচেতন হওয়ার।
...............ক্রমশ দেখুন